আমাদের চারপাশে ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। যে কাজ করলে মঙ্গল হয় সেটি ভালো কাজ। আর যে কাজ করলে অমঙ্গল হয় সেটি হচ্ছে মন্দ কাজ। কোনটা ভালো কাজ আর কোনটা মন্দ কাজ তা বিচার করার জ্ঞানকে বলে নীতি। নীতির সঙ্গে যা যুক্ত হয় তা-ই নৈতিকতা। নৈতিকতা বলতে বোঝায় ভালোকাজ ও মন্দ কাজের পার্থক্য বুঝতে পারা। নৈতিকতা একটি চারিত্রিক গুণ, একটি মূল্যবোধ। সত্যবাদিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবিকতা, সহমর্মিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সম্প্রীতি, দেশপ্রেম এ সবই নৈতিকতা। নৈতিকতা ধর্মের অঙ্গ। এখন আমরা সত্যবাদিতা ও ভ্রাতৃপ্রেম সম্পর্কে জানব ।
প্রাচীনকালে গৌতম নামে এক ঋষি ছিলেন। একদিন তিনি তাঁর আশ্রমে শিষ্যদের নিয়ে ধর্মশাস্ত্র বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় একটি বালক মাথা নিচু করে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। ঋষি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?”
বালকটি হাত জোড় করে প্রণাম করে উত্তর দিল, “আমার নাম সত্যকাম। আমার বাড়ি পাশের গ্রামে। সেখান থেকেই আপনার কৃপালাভ করার জন্য এসেছি।”
ঋষি গৌতম বললেন, এখানে কী চাও?বালকটি বিনীতভাবে উত্তর দিল, গুরুদেব, আমি আপনার নিকট ব্রহ্মচর্য পালন করে ধর্মবিষয়ে শিক্ষালাভ করতে চাই।”
তখন ঋষি তার পিতৃপরিচয় জানতে চাইলেন। বালকটি করজোড়ে বলল, “গুরুদেব, আমি আমার পিতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা, তবে বাড়িতে আমার মা আছেন। মার কাছ থেকে জেনে আগামীকাল আপনাকে বলব।” ঘরে এসে সত্যকাম মাকে সব কথা খুলে বলল। তার মা তাকে তার পিতা সম্পর্কে তেমন কিছু না বলে শুধু বললেন, “আমার নাম জবালা। তাই তুমি জাবাল সত্যকাম।”
পরের দিন সত্যকাম ঋষির আশ্রমে গিয়ে গুরুদেবকে বিনয়ের সাথে বলল, “গুরুদেব, আমার মা আমার পিতা সম্পর্কে কিছু বলেননি। মা শুধু বলেছেন, আমি জবালা। তাই তুমি জাবাল সত্যকাম।” এমন নির্ভীক সত্যকথা শুনে ঋষি সত্যকামকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন,“বৎস, সত্যকাম, তুমি সত্যকথা বলেছ। এমন সত্যকথা সকলে বলতে পারে না। একমাত্র সত্যবাদী এবং সৎসাহসীরাই এমন সত্য কথা বলতে পারে। তোমার এই সত্যবাদিতায় আমি খুশি হলাম। আমি তোমাকে ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করব।” সেদিন থেকে সত্যকাম ঋষি গৌতমের আশ্রমে থেকে বিদ্যাচর্চা আরম্ভ করল।
সত্য সর্বদা প্রকাশিত । সত্য প্রকাশ করা উচিত । সত্য কখনও গোপন করা যায় না ।
স্বার্থহীন ভালোবাসার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সহোদরের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের শ্রদ্ধা-ভালোবাসাই হলো ভ্রাতৃপ্রেম। আমরা ভ্রাতৃপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাই বাল্মীকি রচিত রামায়ণে রাম ও লক্ষ্মণের মধ্যে। অযোধ্যার রাজা দশরথের ছিল তিন রানি। বড় রানি কৌশল্যার পুত্র রামচন্দ্র। মেজ রানি কৈকেয়ীর পুত্র ভরত। এবং ছোট রানি সুমিত্রার দুই পুত্র লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। ছোটবেলা থেকেই রাম ও লক্ষ্মণের মধ্যে ছিল খুব ভাব। রাম-লক্ষ্মণ দুটি ভাই যেন এক প্রাণ, এক আত্মা। এদের একে অপরের জন্য ছিল গভীর স্নেহ ও ভালোবাসা। পিতৃসত্য রক্ষার জন্য রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যেতে হয়। তখন তাঁর বনবাসের সঙ্গী হন স্ত্রী সীতা। ভাই লক্ষ্মণ তখন তাঁর স্ত্রীকে ছেড়ে দাদার সাথে বনবাসে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। দাদা রামের শত আপত্তি সত্ত্বেও লক্ষ্মণ রাজ্যসুখ পরিত্যাগ করে দাদার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থেকেই এ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিঃসংকোচে নিজের জীবনের চৌদ্দটি বছর ভাইয়ের সেবার জন্য উৎসর্গ করেন। তিনি সর্বদা রামের ছায়া সঙ্গী ছিলেন। রামচন্দ্রও তাঁর ভাই লক্ষ্মণকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বনবাসে থাকা কালে তিনি একাধারে রামের ভাই বন্ধু ও সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। তিনি সর্বক্ষণ দাদার পাশে থেকেছেন। তাঁর সেবা করেছেন। । বিপদের কোনো আঁচড় দাদার গায়ে লাগতে দেননি।
লক্ষ্মণ কর্তৃক মেঘনাদ বধ ছিল দাদা রামকে ভালোবাসার একটি বড় উদাহরণ। মেঘনাদ ছিলেন লঙ্কার রাজা রাবণের পুত্র। তিনি ছিলেন মহাপরাক্রমশালী একজন যোদ্ধা। তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করা ছিল একরকম অসম্ভব ব্যাপার। সেই অজেয় মেঘনাদকে লক্ষ্মণ বধ করেন। এতে রামের লঙ্কা জয় সহজ হয়।
লক্ষণের মতো ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। আজও মানুষ ভাইয়ে ভাইয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে রাম লক্ষ্মণের উদাহরণ দেয়।
বাস্তব জীবনে আমরা রামায়ণের এই দুই ভাইয়ের চরিত্র থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা আমাদের নিজেদের ভাই বোনের সাথে সহপাঠীদের সাথে প্রতিবেশীদের সাথে সব সময় সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব । কখনো কারো সাথে ঝগড়া করব না। হিংসা বিদ্বেষ করব না। সকলে মিলে মিশে একত্রে বসবাস করব। সকলে সকলের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিব। তাহলেই আমাদের জীবন হয়ে উঠবে অনেক সুশৃঙ্খল, সুন্দর ও আনন্দময়।
অনেক দিন আগের কথা। হস্তিনাপুরে বাস করতেন কর্ণ নামে একজন মহাশক্তিশালী বীর। তিনি দাতাকর্ণ নামেও পরিচিত। তিনি ছিলেন সূর্যদেব ও কুন্তীর পুত্র। তিনি জন্মেছিলেন একটি কবচ ও কুণ্ডল নিয়ে। এই কবচ কুণ্ডলের গুণে তিনি ছিলেন অপরাজেয়। ছোটবেলা থেকেই অস্ত্র ও ধনুর্বিদ্যা শিক্ষার প্রতি তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। কর্ণ অস্ত্র শিক্ষার জন্য ভগবান পরশুরামের কাছে যান।
পরশুরাম ছিলেন অস্ত্র বিদ্যার গুরু। তিনি কর্ণকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন। গুরুর প্রতি ছিল কর্ণের গভীর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। তিনি গুরুগৃহে থেকেই অস্ত্র শিক্ষার বিভিন্ন কৌশল অনুশীলন করতে থাকেন। গুরুর প্রতিটি আদেশ তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে মেনে চলতেন। গুরুর আদেশেই তিনি কঠোর অধ্যবসায় ও নিরলস পরিশ্রম করে অস্ত্র ও ধনুর্বিদ্যা আয়ত্ত করেন।
এভাবে দীর্ঘ দিন কেটে যায়। একদিন গুরু পরশুরাম তাঁর শিষ্যদের অস্ত্র শিক্ষা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তিনি একটি প্রস্তরখণ্ডের ওপর বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্য এগিয়ে যান। এমন সময় শিষ্য কর্ণ গুরুদেবকে বলেন, গুরুদেব শক্ত প্রস্তরখণ্ডের ওপর বিশ্রাম নিতে আপনার কষ্ট হবে । গুরুদেব, দয়া করে আপনি আমার কোলে মাথা রেখে শান্তিতে বিশ্রাম করুন। এ কথা শুনে পরশুরাম বললেন, এতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ এভাবে বিশ্রাম নেয়া আমার অভ্যাস আছে। কিন্তু কর্ণ গুরুকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করে তাঁকে রাজি করান। পরশুরাম শিষ্যের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। কর্ণ তখন গুরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। হঠাৎ বনের ভিতর থেকে একটি বিষাক্ত কীট এসে কর্ণের হাঁটুতে কামড় দেয়। এই বিষাক্ত কীটের কামড়ে কর্ণের পা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরতে থাকে। তাঁর পরিধানের কাপড়টি রক্তে ভিজে যায়। প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও গুরুদেবের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে তিনি দাঁতমুখ চেপে ব্যথা সহ্য করেন। এতটুকুও নড়াচড়া করেননি। গুরুজনের প্রতি কতটা ভক্তি ও শ্রদ্ধা থাকলে এতটা কষ্ট সহ্য করা যায়!
একটা বিষাক্ত কীটের কামড়ের যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি গুরুকে কিছু বুঝতে দেননি। গুরুদেবের ঘুমের বিঘ্ন ঘটুক এটা কর্ণ চাননি। গুরুদেবের প্রতি মহাবীর কর্ণের এই ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমাদের কাছে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
আমরাও কর্ণের মতো হব। মা বাবা ও শিক্ষকসহ সকল গুরুজনকে শ্রদ্ধা করব। তাঁদের আদেশ মান্য করব। অর্জন করব গুরুজনে ভক্তির মতো নৈতিক গুণ।
Read more